জীনের কবলে রঞ্জু

-কাজী মো: হাসান

সব বিদায় মূহুর্তই খুব কষ্টের। এতোদিন যাদের সঙ্গে হেসেছে, খেলেছে, সুখ-দুঃখগুলো মিলেমিশে ভাগাভাগি করে উপভোগ করেছে, সেই বন্ধুদের ফেলে রঞ্জুর এই চলে যাওয়াটাও সত্যি খুব কষ্টের। বন্ধুরা অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। রঞ্জু তো নয়-ই, সবার মুখে একটাই কথা-
: আবার কবে আসবি?
কী করে বলবে সে? রঞ্জু কী জানে, আবার কবে আসবে?
পরদিন সকালেই রঞ্জুরা চলে যায় নতুন বাড়িতে। জায়গাটা যে একদম নতুন, এমন নয়! সে বহুবারই এখানে এসেছে। কখনো ঈদ উপলক্ষ্যে, কখনো বা দু’তিন দিনের জন্য বেড়াতে। হয় দাদুর সঙ্গে, নয় আব্বুর সঙ্গে।এখানে বলে রাখা রঞ্জুর ছোট আর এক ভাই আছে। নাম মঞ্জু। সে আব্বু আম্মুর সঙ্গে এখানেই থাকে।

এবারের আসাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগে এসে ক’দিন বেড়ানোর পরই আবার ফিরে গেছে। কিন্তু এবার থেকে এখানেই থাকতে হবে, মাঝে মাঝে যাবে গ্রামের বাড়িতে। দাদুর কাছে। ভাবতেই কান্না পায় রঞ্জুর। কী করে দাদা-দাদীকে ফেলে থাকবে সে?
জায়গাটা থানা ভবন ও বাজার থেকে কোয়ার্টার মাইলের মধ্যে। গ্রামের নাম শিবপুর। এ গায়েরই এক কৃষকের বাড়িতে থাকছে তারা। ভাড়া বাড়ি।
কৃষকের পরিবারটা খুব ছোট কিন্তু বাড়িটা বেশ বড়। বাড়িতে কয়েকটা চৌচালা ঘর। সবগুলোরই চৌকাঠ করা বেড়া। বাড়ির পশ্চিম দিকটায়, একটু দূরে গোয়াল ঘর। গোয়াল ঘরের ভেতরে একটা খোয়ার, বাইরেও আছে। একটা। বাইরের খোয়ারের পাশে গরুগুলোকে পানি খাওয়ার জন্য বিরাট গামলা। সন্ধ্যায় মাঠ থেকে গরুগুলো এনেই পানি খাইয়ে খোয়ারে বেঁধে খড় দেয়া হয়। তখন খড় খাওয়ার দিকে গরুলোর কোন মন থাকেনা, বরং শুয়ে শুয়ে অলস ভাবে ঝিমুতে ঝিমুতে জাবর কাটতেই পছন্দ করে বেশী। আর এগুলো দেখাশুনার জন্য রয়েছে একজন কামলা।
গ্রামের কৃষক হলে কী হবে, পরিবেশটা বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, শান্ত নদীর মতো একদম পরিপাটি। হৈচৈ বিহীন নিশ্চুপ। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড় রাস্তার পাশেই বাড়িটা। সবদিক খোলামেলা।
সংসারে তেমন কেউ নেই। এক মেয়ে এবং এক ছেলে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর হয়ে গেছে। ছেলের নাম- রউফ। মাত্র তের-চৌদ্দ বছরের যুবক। লেখাপড়া করছেন মক্তবে। রঞ্জুরা তাকে কাকা বলেই ডাকে।
বাড়ির মূল গিন্নি জমিলা খাতুন। এখন তিনিই রঞ্জুদের নতুন দাদী। ভারি মজার মানুষ। সারাক্ষণ হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখেন। তাঁর দোষগুণ বলতে একটাই- কেবল হাসেন। কাজে হাসেন, আবার অকাজেও হাসেন। কথা বলতে গেলেই হাসেন। কোন মতেই হাসি আর থামে না। মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বাম হাতের তালুতে ডান হাতের পিঠ চাপড়ে এমন ভাবে হেলে-দুলে পড়েন যেন, মোমের মতো খয়ে খয়ে পড়ছে তাঁর শরীর। এক কথায় খুশীর বন্যায় ছয়লাপ তাঁর জীবনের প্রতিটি পাতা।

রঞ্জুদের ঘরটা বাড়ির একদম পূর্ব দিকে। উত্তর দক্ষিণে লম্বা। পূর্ব মুখি। দক্ষিণে বারান্দা। ঘরের চালের চারপাশ ঘিরে টিনের কারুকাজ। এ ছাড়া সামনে এবং ডানে আলাদা বারান্দা। অনেকটা কোটা ঘরের মতো। ঘরের ভেতর টিনের পার্টিশন টেনে রুম করা হয়েছে তিনটা। দক্ষিণের রুমটায় বৈঠকখানা। বাড়িতে মাঝে মাঝে এখানেই আব্বু রুগী দেখেন।
যেখানে যা-ই করুন না কেন, নতুন দাদীর একটা চোখ সারাক্ষণ পড়ে থাকে রঞ্জুদের উপর। তারা কখন চিৎকার দেয়, কখন মাদ্রাসা থেকে বাড়ি আসে, কখন খেতে বসে- সব তাঁর নখদর্পণে। ন্যায় অন্যায় বলতে কোন কথা নেই, রঞ্জুদের বিপদ এলেই তিনি এক পায়ে খাড়া। তাদের গায়ে ফুলের টোকা দিলেও রেহাই নেই কারোর। হাজারটা ধমকের মোকাবেলা করতে হয় তাকে।
নতুন জায়গায় এসে একটু একটু করে সুস্থ্য হতে থাকে রঞ্জু। এখন ছোটখাট অপরাধ সহজে আমলেই নেয় না কেউ। বরং রুগীর উন্নতি দেখে সবাই খুশী।
বাড়ি থেকে একশ’ গজের মধ্যে মসজিদ। ওয়াক্তিয়া নামাজ ছাড়াও রোজ সকালে মক্তব চলে। এখানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। এক মাস পর রঞ্জুকেও ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় সেখানে। সবার ধারণা, নতুন বন্ধু-বান্ধব পেলে হয়তঃ রঞ্জুর রোগমুক্তিটা আরো দ্রুত হবে।

মক্তবটা খুব সুন্দর। ইমাম সাহেবর নেতৃত্বেই চলে এটা। তিনি কোরআনে হাফেজ। খুব সহি শুদ্ধ ভাবে বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দেন তিনি।
ইতিমধ্যেই রঞ্জুর কায়দা শেষ। এখন আমপাড়া পড়ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন ছুটির আগে ইমাম সাহেব পবিত্র কোরআনের শেষ দিকের সুরাগুলো উচ্চস্বরে কেরাত করে পড়ান। বাচ্চারা সবাই মিলে হেসে খেলে সুর তুলে সেই সুরাগুলো পাঠ করে। সবার কাছেই এ পড়াটা ভীষণ মজার। ছড়ার মতো পড়তে পড়তে প্রায় সব সুরাই মুখস্তই হয়ে গেছে রঞ্জুদের।
বেশ আনন্দ ফুর্তির মধ্যেই দিনগুলো কাটছিলো তাদের। হঠাৎ একদিন ঘটে অন্য এক ঘটনা। ঘটনাটা মজার হলেও বেশ উৎকণ্ঠার। মক্তব ছুটির পর রঞ্জু বেরিয়েই দেখে, তার চটিগুলো লাপাত্তা। সবাই মিলে আশ-পাশে, আনাচে-কানাচে, সব জায়গায় খুঁজাখুজি করে। কোথাও চটি নেই। কে নিয়েছে, কেন নিয়েছে- তা আল্লাই জানেন! শেষ পর্যন্ত চটি ছাড়াই বাড়ি ফিরতে হলো রঞ্জুকে।
প্রথম দিকে রঞ্জুরা ভেবেছিলো হয়ত ভুল করে কেউ চটিগুলো নিয়ে গেছে। কিন্তু এর পর এক মাসের মধ্যে পর পর তিন বার ঘটে ব্যাপারটা। শুধু মাত্র তার চটিগুলোই নিয়ে গেছে প্রত্যেকবার।

এদিকে চটি হারানোর অভিযোগে প্রথম বার মাফ করলেও দ্বিতীয় বার খুব বকুনি দিলেন আম্মু। রঞ্জুর গাফলতির জন্যই নাকি এমন হয়েছে।
অথচ সে ভেবেই পায় না, এতে গাফলতির কী আছে? সে তো আর চটিগুলো রাস্তায় রাখেনি? স্পষ্ট মনে আছে, মক্তবের ঢুকার পথে দরজার পাশে রেখেছিলো সব। তারপরও কী ভাবে যে কী হয়ে গেছে, বুঝতেই পারে না। সবার চটি-ই তো ঠিকঠাক, শুধু তারটাই নেই! কিন্তু কেন? রহস্যটা কোথায়? রঞ্জু হাজার ভেবেও এর কুলকিনারা করতে পারে না। বরং গোলমালটা দিনকে দিন বাড়ে।
আগে এখনকার মতো স্পঞ্জের সেন্ডেল ছিলো না। বাড়িতে বাচ্চা এবং মেয়েরা কাঠের তৈরী চটি আর পুরুষ-মুরুব্বরা খড়ম পড়তেন। এসব পড়লে একটাই অসুবিধা, হাটতে গেলে চটচট আওয়াজ হয়। হাটার সময় সতর্ক না থাকলে, বৃষ্টির দিনে আওয়াজের সাথে সাথে প্যাক-কাদা উঠে পেছন দিকের জামা-কাপড়ের বারটা। সে এক মারাত্মক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

দিন যায়। রঞ্জুর বন্ধুর দলটা বাড়ে। সবাই খুব ভালো। একদিন বিকেলে বন্ধুদের মধ্যে- রশিদ, ফজলু, বিমল, আবুল ও লিটন তাদের বাড়িতে এসে হাজির। ওরা খেলতে যাচ্ছে । সে যাবে কি-না সেটাই জানতে চায়-
: রঞ্জু, আমরা গোল্লা খেলতে যাচ্ছি। যাবি আমাদের সাথে?
: হ্যাঁ যাবো।
: চল তা হলে।
রঞ্জুর সঙ্গে মঞ্জুও সঙ্গী হয়। আম্মুকে বলে খেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় দু’ভাই। এই প্রথম বাইরে যাওয়া। তাই ফুটানী দেখানোর জন্য দামী জুতুজোড়া পড়ে নিলো ঝটপট।
খেলতে খেলতে সন্ধ্যা। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে একটু একটু করে। ইতিমধ্যেই মাগরিবের আযান হয়ে গেছে। এখন না ফিরলে মা নিশ্চিত বকুনি দেবেন। তাই তাড়াহুড়– করে বাসার পথ ধরে তারা। ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় পায়ের দিকে তাকিয়ে রঞ্জুর তো মাথায় হাত-
: আরে, পায়ের জুতা গেলো কই?
সত্যি, রঞ্জুর তো পা খালি। খেলার আগে সেগুলো খুলে রেখেছে, এমনটাও মনে পড়ছে না। তা হলে জুতাগুলোর কি হলো? মা জুতুর কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলবে সে?
অসহায় ভাবে মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শুরু করে-
: ইয়া আল্লাহ্! তুমি আমাকে রক্ষ করো, পিট্টির হাত থেকে বাঁচাও!
বাসায় ঢুকার সময় ছোট ভাই মঞ্জুকে পই পই করে বলে রাখে-
: দেখিস, জুতা হারানোর কথাটা যেন আম্মুকে আবার বলে দিস না। মঞ্জু বড় ভাইয়াকে কথা দেয়-
: ঠিক আছে, বলবো না।
কিন্তু বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই আম্মুর গলা। কলতলা থেকেই ডাকছেন তিনি-
: এই যে রঞ্জু-মঞ্জুু, এদিকে আয়। হাত মুখ ধুয়ে যা।
বিপদ আর কাকে বলে! কথায় বলে না- যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়! রঞ্জুর অবস্থা হলো তাই।

আম্মুর কাছে গেলেই তো জিজ্ঞেস করবেন- তোর জুতা কই? তখন কী জবাব দেবে? সঠিক উত্তরটা কোন মতেই মাথায় আসছে না। তাই রঞ্জৃুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নেয়, ভাবতে থাকে। একে তো নামাজের সময়। তার উপর তাদের বিলম্ব দেখে আম্মুর কন্ঠস্বর উঠে যায় তারাগ্রামে-
: কিরে, তোরা আসছিস না কেন?
রঞ্জু নিরুপায়, অসহায়, ভয়ে কাচুমাচু। তারপরও পা টিপে টিপে আম্মুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। তিনি প্রথমেই ডাকেন রঞ্জুকে। হাত পা ধোয়াতে গিয়ে তাঁর চোখ যায় পায়ের দিকে। তিনি নির্বিকার গলায় জানতে চাইলেন-
: হ্যাঁরে রঞ্জু, তোর পায়ে না জুতা ছিলো। সেগুলো কই?
রঞ্জু চুপচাপ।
আবার জিজ্ঞেস করলেন-
কিরে জুতা কই? কথা বলছিস না কেন?
একবার, দুইবার, তিনবার জিজ্ঞেস করলেন। তারপরও রঞ্জু চুপচাপ। এবার ক্ষেপে গেলেন তিনি-
: কিরে, কথা বলছিস না কেন? মুখে কুলুপ দিয়েছিস?
তারপরও কোন উত্তর না পেয়ে আম্মুর মেজাজ টং। দ্রুত একটা পাটশলা এনে রুদ্রমূর্তি নিয়ে দাঁড়ালেন সামনে। পাটশলা দেখিয়ে ধমকে উঠলেন-
: চুপ করে থাকলে আজ তোর পিঠে এটা ভাঙ্গবো!
কথাটা বলেই আম্মু থামলেন। কড়া চোখে তাকালেন রঞ্জুর দিকে-
কিরে, কিছু শুনছিস তুই?
উত্তর দেবে কি- বেত দেখে ভয়ে রঞ্জুর আত্ম এমনিতেই খাঁচা ছাড়া! কোনমতেই কথা বের হতে চায় না গলা দিয়ে। তবু তোতলাতে তোতলাতে বললো-
: বলতে পারবো না!
: বলতে পারবো না মানে? তুই না জুতা পড়ে বের হলি?
: হ্যাঁ, পড়েছিলাম। তারপর—–
সবটা শেষ করতে পারে না রঞ্জু। তার কথাটা কেড়ে নিয়ে বাকিটা পূরো করলেন আম্মু-
: হারিয়ে গেছে, এই তো বলবি!
উত্তরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে শুধু মাথা নাড়ে।
: নতুন জুতা। এই তো এক মাসও হয়নি কিনলি। এর মধ্যেই নেই। আজ চটি নেই, কাল জুতা নেই। কি যে করা এই ছেলেকে নিয়ে—-। চিন্তার ভাজ পরে আম্মুর কপালে।
আম্মু বাড়ির মালিকের ছেলে রউফ কাকাকে ডেকে পাঠালেন। রঞ্জুর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন জুতার খোঁজে। সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলো তারা। কিন্তু জুতার টিকিটিও নেই।
শাসনের ভয়ে বাড়িতে ফেরার আগেই রঞ্জুর অবস্থা কাহিল। আজ বাড়িতে গেলে তার পিঠের উপর দিয়ে নিশ্চিত একটা তুলকালাম কা- ঘটে যাবে !
অথচ আশ্চর্য, কিছুই ঘটলো না। সব মাফ। আসলে, রঞ্জুর স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই হয়তো এতোটা ছাড়!

আম্মু মাফ করলে কি হবে, রঞ্জু কিন্তু বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিতে পারলোনা। যে করেই হোক- জুতা, চটি এসব হারিয়ে যাওয়ার কারণটা তাকে জানতেই হবে। বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে বন্ধুদের সাথে। প্রধান এজেন্ডাা হিসেবে বিষয়টা তুলে ধরে বন্ধু সভায়। শুরু হয় আলোচনা। চলে একটানা কয়েকদিন-
: আচ্ছা বলতো, কী করে এমনটা হচ্ছে? তোদের বেলায় তো সব কিছুই ঠিকঠাক। শুধু আমার ক্ষেত্রেই যত্তো ঝামেলা! আসলে, ব্যাপারটা কি বলতো?
উত্তরটা যেন লিটনের মুখের উপর তৈরীই ছিলো-
: আমার কি মনে হয় জানিস, এটা চোরদেরই কাজ। এরা ছাড়া এমন কাজ কে করবে, বল?
রাজ্জাকের মত ভিন্ন। তাই হাত বাড়িয়ে লিটনকে থামিয়ে দেয়। মসজিদ থেকে চুরি যাওয়ার কথাটা একদমই বিশ্বাস করতে পারে না-
: দূর গাধা! মসজিদে চোর আসবে কোত্থেকে? সকালে এখানে তো শুধু ছাত্ররাই আসা-যাওয়া করে। তারা কি চোর?
: তাই তো! এখানে সবাই তো নামাজ আর কোরআন পড়তে আসে। এদের মধ্যে চোর আবার কে?
চুরির কথা বাদ দিলেও রঞ্জুর মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
তবে যে যা-ই ভাবুক, বন্ধুদের মধ্যে ফজলুর ভাবটাই অন্য রকম। সে সব জান্তার মতো বিজ্ঞ বিজ্ঞ মতামত দেয় প্রতিটি সমস্যায়। আজো তার অন্যথা নেই-
: আমার মনে হয় কি জানিস- এটা চোরদের কাজ নয়। ভুলে করে কেউ নিয়ে গেছে, এমনটাও মনে হচ্ছে না। চোর হলে, এতোদিনে আমাদের হাতে ধরা পড়তোই। তাও তো পড়েনি। সুতরাং আমি নিশ্চিত- এটা জ্বীন-পরীদের কাজ। কেবল ওদেরকেই আমরা দেখতে পাইনা। সেই সুযোগটাই তারা কাজে লাগিয়েছে। জামান তীব্র ভাষায় ফজলুর কথার প্রতিবাদ করলো। বললো-
: তাই বলে রঞ্জুর জিনিসটাই তারা নিতে আসবে কেন? সেখানে আরো অনেকেরই জুতাই তো ছিলো ! কই, কারোর জুতাই তো নেয়নি!
উত্তরে ফজলু আবারো তার কথার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে-
: হয়তঃ রঞ্জুকেই তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এবার তার সঙ্গে বন্ধু পাতাতে চায়। না হলে বেছে বেছে তার জিনিসগুলোই নেবে কেন? একবার না, দু’বার না, পর পর কয়েকবার।
ফজলুর কথায় যতেষ্ঠ যুক্তি আছে। আবুল তাকে সমর্থন করে। পাশাপাশি তুলে ধরে একটা ঘটনা। শুনেছে তার ফুফুর কাছে। ভীষণ লোমহর্ষক ঘটনা। এ যেন এক রূপকথা।

কয়েক বৎসর আগের কথা। তবু মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। হয়েছিলো কী- সুলতানসাদী গ্রামের এক মেয়ে- কমলা। বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। কমলাও ছিলো উচ্ছল, চঞ্চল একটা মেয়ে। হেসে খেলে সে সারাবাড়ি মাথায় করে রাখতো।
দেখা গেলো, কমলা তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘরের দাওয়ার বসে এক্কা-দোক্কা খেলছে। হঠাৎ সে হ্ওায়া। এবার সে কলই ক্ষেতে ঘাস তুলে গরুকে খওয়াচ্ছে।
একদিন এই কমলা বাড়ি থেকে উদাও।
শুরু হয় খুঁজাখুজি। মা-বাপ তো বটেই, আত্মীয়-স্বজনেরা কেউ বাদ নেই এই খুঁজাখুঁজিতে। সবাই খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে। খুঁজতে খুঁজতে কেটে যায় কয়েক সপ্তাহ। যে যেখানে যেতে বলেছে সেখানেই গেছে, যে যা করতে বলেছে তাই করেছে। কিন্তু কোন হদিস নেই কমলার। কি হয়েছে কে জানে! কয়েক সপ্তাহ পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে- হয়তঃ ভুত-পেতœী তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মেরে ফেললে লাশটা তো থাকবে? তাও তো নেই!
ঘুরে ঘুরে শেষমেশ ফুলতলীর পাগলা বাবার দরবারে গিয়ে হাজির হলেন কমলার মা-বাবা। আয়না পড়া দিলেন তিনি। আয়নায় না-কি ভেসে উঠেছে কমলার চেহারা। সঙ্গে সব ঘটনা। পাগলা বাবা জানালেন- কমলাকে নাকি জ্বীনেরা ধরে নিয়ে গেছে। তিনি আরো বললেন- প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গারো পাহাড়ে। সেখানে তিন দিন তিন রাত রাখার পর সোজা জ্বীনদের দেশে।
জ্বীনদের দেশটা নাকি ভীষণ সুন্দর! চারদিকে বাগান, মন কাড়া সৌন্দর্য, পাগল করা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি, ভ্রমরা এবং প্রজাপতিদের অভয়ারণ্য। দোয়েল, কুকিল, কাকাতুয়া, বুলবুলির মতো হাজার রকম পাখপাখালি সারাদিন ঘুরে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। এ ছাড়া, গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে আছে কাঁচা-পাকা ফল। ইচ্ছে করলে যে কেউ গাছ থেকে পেড়ে খেতে পারে। যত খুশী খাও, কোন বাঁধা নেই। আর আছে পঙ্খীরাজ ঘোড়া। ইচ্ছে হলেই ঘোড়ায় চড়ে বসো এবং উড়ে যাও যেখানে খুশী সেখানে।
কিন্তু কোন কিছুতেই কমলার মন নেই। বাপ-মা, ভাই-বোনদের ছেড়ে সেখানে একদন্ডও থাকতে ইচ্ছে করেনা তার। প্রতিটি মুহুর্ত দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।
সে শুধু দেশে আসতে চায়। ফিরে পেতে চায় মা-বাবা-ভাই-বোনদের। এ জন্য প্রথম দিন থেকেই প্রতিবাদ শুরু। কিন্তু তারাও নাছোড়বান্দা। সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয় জ্বীনেরা।
তাই মন ভোলাবার জন্য সেমাই, ফিরনী, কোর্মা, পোলাও- এভাবে হাজার রকম সুস্বাদু খাবার নিয়ে আসে কমলার জন্য। তার সাথে টসটসে পাকা ফল। রসগোল্লা, চমচম, প্রাণহারা এসব মিষ্টিও আনে ঢালা ভর্তি। আরও কত ধরণের সুস্বাদু খাবার! এতো কিছু পেয়েও তার মন ভরে না। সে শুধু বাড়ি ফিরতে চায়। শুরু হয় কান্নাকাটি। এক সময় আমরণ অনশন।
পার হয় দিন, পার হয় সপ্তাহ, তার পর মাস। কমলা না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে কঙ্কাল। দুর্ব্বল, কোটরাগত চোখ, তেলহীন চুল- জট পাকিয়ে একদম পাগলের মতো। এখন মরে তো তখন মরে অবস্থা।
বিষয়টা নিয়ে জ্বীনেরা বৈঠকে বসে। কমলাকে নানা ভাবে বুঝাতে থাকে তারা। একদিন জ্বীনের রাজা আসেন কমলাকে বুঝাতে। কিন্তু কমলা তার সিদ্ধান্তে অটল। কোন ভয়, লোভ বা আশ্বাসেই তার অনশন ভাঙ্গানো গেলো না। প্রতিজ্ঞাটা এমন যেন মরে গেলেও সই, অনশন ভাঙ্গবে না। তার এক কথা- আমি নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই!
একমাস পর হার মেনে কমলাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় জ্বীনেরা। এক রাতে চুপি চুপি এসে তাকে ঘরের চালের উপর শুইয়ে রেখে পালিয়ে যায় জ্বীনেরা।
কমলাকে ফিরে পেয়ে বাবা মায়ের আনন্দ আর ধরে না। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু পাড়া প্রতিবেশীরাও তাকে দেখতে আসে।

গল্পটা শুনে সবার গা ছম ছম। লোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠে । ভয়ে বুকের ভেতরে দ্রিম দ্রিম ড্রামের আওয়াজ শুরু হয়। তবে রঞ্জুর ভয়টা অন্য জায়গায়। সত্যি সত্যি যদি তাকেও জ্বীনেরা ধরে নিয়ে যায়, তখন সে কি করবে? হাবভাব দেখে তো এমনটাই মনে হচ্ছে। নিশ্চয় জ্বীনেরা পছন্দ করেছে তাকে! ্না হলো এতো সব ঘটনা ঘটবে কেন? তাকে ভয় পেতে দেখে আশ্বস্থ করে লিটন। কাছে এসে পিঠ চাপড়ে সাহস দেয়-
: আরে বুদ্ধু! জ্বীনেরা তোকে নেবে কেন? মামার কাছে শুনেছি- জ্বীনদের দেশে নাকি মেয়ের সংখ্যা খুব কম। তাই তারা শুধু মেয়েদেরই তুলে নেয়। তুই তো আর মেয়ে না! সুতরাং তোর কোন ভয় নেই।
লিটনের কথা সত্য কি মিথ্যা- জানা নেই! তাই লিটনের কথায় সাহস পেলেও ভয় কাটে না। তবে ফজলুর কথা ভিন্ন। সে কোন মতেই লিটনের কথাটা মানতে নারাজ। তার অভিমত- পুরুষ জ্বীনেরা মেয়েদের নেয়, আর মেয়ে জ্বীনেরা পুরুষদের নেয়। সুতরাং রঞ্জুর প্রতি মেয়ে জ্বীনদেরই যে নজর পড়েছে, সেটা একশ’ ভাগ নিশ্চিত।
ফজলুর কথায় রঞ্জু আবার দুচিন্তায় পড়ে। ভয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। এবার এগিয়ে আসে ফজলু। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দেয়-
: একদম ভয় পাবি না রঞ্জু। এখন থেকে আমরা সবাই মিলে এমন গার্ড দেবো না, ঐ জ্বীনের বাপও তোর ধারে কাছে আসতে পারবে না।
যে যা-ই বলুক, রঞ্জুর ভয় কিন্তু কাটে না। জ্বীন-পরীদের ব্যাপার তো! তাদের না দেখা যায়, না কথা শুনা যায়! তারা কখন আসে, কখন যায় কিছুই বুঝার উপায় নেই। এসেই যদি হঠাৎ তাকে ধরে শূন্যে উড়াল দেয়, তখন কি করবে সে! অদৃশ্য শক্তির কোন বিশ্বাস আছে?
এবার সবার পক্ষ থেকে সাহস দেয় আবুল-
: দূর! তুই এতো ভাবছিস কেন? আমরা আছি না! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোর ভয়ের কিচ্ছু নেই। বরং জ্বীনেরাই ভয় পেয়ে তোকে না নিয়ে তোর জুতা জোড়া এবং চটিগুলো নিয়ে গেছে। আরে বল্লাম তো, সাহস থাকলে জ্বীনেরা আবার আসুক না, দেখি কত বড় বুকের পাটা- ঠিক বারটা বাজিয়ে ছাড়বো আমরা!
বন্ধুরা একে অপরের হাতের উপর হাত রেখে শপথ নেয়- এখন থেকে সবাই মিলে খুব সাবধান থাকবে। রঞ্জুর ধারে কাছেও ঘেষতে দেবে না জ্বীনদের। দরকার পড়লে সবাই মিলে পালা করে পাহাড়া দেবে।
সেদিন থেকে আসলেই সবাই সতর্ক দৃষ্টি রাখে রঞ্জুর উপর।
(চলবে————)
(‘রঞ্জুর ছলেবেলো’ থেকে)

Related posts

Leave a Comment